এই সেই নি:স্তব্দ বিভীষিকাময় রাত

প্রথম প্রকাশঃ মার্চ ২৫, ২০১৯ সময়ঃ ৮:৩৪ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৮:৩৪ অপরাহ্ণ

সেদিন সারাদিনের কর্মব্যস্ততাকে পেছনে ফেলে যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। কেউবা ঘুমোতে যাচ্ছে। চারদিক সুনশান নিরবতা। মা তার সন্তানকে জড়িয়ে ধরে পরম মমতায় আরামের ঘুম ঘুমাচ্ছেন। বাবার চোখে সন্তানের হাসিমাখা ভবিষ্যতের স্বপ্ন। পরদিন কাজে বেরুনোর তাড়া; তাই তাড়াতাড়ি ঘুমোতে হবে। সকালে যে অফিস। এই ভেবে সুখস্বপ্নের দরজায় কপাট লাগিয়ে চোখদুটো মাত্র বন্ধ করলেন। এমন সময় হঠাৎ রাতের অন্ধকারের নির্জনতাকে ছাপিয়ে একপাল সাঁজোয়া যানের বিরক্তিকর গরগর শব্দ। কিছু বুঝে উঠার আগেই অনড় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ; কোনো কোনো দরজায় আরো জোরে লাথি মেরে ভাঙার হিড়িক পড়ে গেছে। তখনও ঘুমকাতুরে চোখে কেউ মৃত্যুর মিছিলে শামিল হওয়ার কথা ভাবতেই পারেনি। এদিকে ভয়ে আতঙ্কে অপস্তুত ঘুমন্ত মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে দ্বিগবিদিগ ছুটতে থাকে।

কোথায় সেই সন্তান, যার কথা ভেবে বাবার দুচোখ খুশিতে ভরে উঠেছিল? কোথায় তার মমতাময়ী মা; যাকে জড়িয়ে ধরে একটু আগে শিশুটি ঘুমিয়েছিল? এ যেন ছিটকে আসা প্রচন্ড উত্তপ্ত দাবানল। হুড়োহুড়ি, চিৎকার আর কান্নার রোলকে ছাপিয়ে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ ভয়ঙ্কর বজ্রপাতের মতো বেজেই চলেছে। হ্যাঁ, একসময় সব থেমেছিল। অসহ্য অস্থিরতা, হুড়োহুড়ি, অসহায় কান্নার রোল সব হাওয়ার মিলিয়ে গেল। চারদিকে পিনপতন নিরবতা; যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সবাই। কিছুসময় পর ভেসে উঠে ঐ নিস্তব্দ নিথর দেহগুলো থেকে শুধুই রক্তের অনির্বাণ স্রোত। যাদের বুক চিড়ে বুলেট পৌঁছেনি তাদের বুকের ভেতর অন্য এক ব্যথা উইপোকার মতো কুড়েকুড়ে খাচ্ছে। মুখে তাই ভাষা নেই, চোখে নিরব অশ্রুফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে নিথর প্রিয়জনের বুকের ওপর।

২৫শে মার্চ গভীর রাত, যেদিন বেঁচে যাওয়াদের গোঁগানী ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। চোখের নোনা ফোটাগুলো ক্ষোভের পুঞ্জিভূত বিস্ফোরণের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণছিল। সেই রাতে মৃত্যুর শোকের মিছিলকে আরও হতাশাব্যঞ্জক করে তুলতে পাক বাহিনীর শকুনী নজর পড়লো বাঙালির প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধুর ওপর। রাতেই চিলের মতো ছোঁ মেরে তাকেও নিয়ে যাওয়া হল প্রিয় স্বদেশ থেকে। এমন অবমস্যার রাতের প্রলয় মাতম ভেঙে বাঙালি কখনও মাথা তুলে উঠে দাঁড়াতে পারবে না এই ভেবে উল্লাসে মেতে উঠে রাক্ষুসের দল। এত রক্ত নিয়েও তাদের প্রাণের পিপাসা মেটেনি। আরও রক্তের নেশায় মাতাল হয়েছিল সেদিনের নিষ্ঠুর পাক সেনার দল। তবে বাঙালি চিরতরে ডুব দিয়েছে অতল চোরাবালিতে। এই বিশ্বাসে দীর্ঘ স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে ভোরের আলো না ফোটা পর্যন্ত আনন্দযজ্ঞে মেতে উঠেছিল।

সূর্যগ্রহণ কাটবে না বাঙালির জীবন থেকে। ছায়াহীন অন্ধকারেও তারা স্বজনের চিৎকার শুনতে পাবে জীবনভর। মাথা তুলে দাঁড়ানোর শক্তি নেই। মেরুদন্ড ভেঙে গেছে। বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই তবুও এ প্রাণটাকে টেনে টেনে বয়ে বেড়াতে হবে আমৃত্যু। কী অদ্ভূত চোখ রাঙানি ইয়াহিয়া, টিক্কা খানদের!

২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে জ্বলজ্বলে এক তেজী সূর্য উদিত হল। আঁধারের বিদঘুটে কালো বিড়াল সরে গিয়ে বাঘের রঙে রাঙিয়ে দিল বাঙালির শোকার্ত হৃদয়। কানে কানে ফিসফিসিয়ে কে যেন শুনিয়ে গেল রণ হুংকার। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়..হবে হবে হবে নিশ্চয়…..।

এবার বাঙালির দেখিয়ে দেবার পালা। যা কেউ ভাবেনি, যা কেউ পারেনি তাই করে দেখাবার দিন এল। কৃষকের লাঙল, শ্রমিকের কবজির জোর, গৃহিনীর অদম্য সাহস আর ছাত্রজনতার এক একটি কলম হয়ে উঠলো যুদ্ধের মারণাস্ত্র। মাথায় গামছা, পরনে সাদা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে সাধারণ শ্রমিক হয়ে উঠলো বাঙালির স্বপ্নের সারথি। এগিয়ে চলল সমস্ত অত্যাচারিত বিভীষিকাময় বিরূপ সময়কে পেছনে ফেলে, ‘চল চল চল’ ধ্বনিতে। জলে স্থলে দাপিয়ে বেড়ায় নির্বিকার অদম্য সাহসী যোদ্ধার দল। তারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধা প্রিয় মুক্তিবাহিনী।

আইয়ুব, ইয়াহিয়ার পালিত সেনার দল এমন রণহুংকার দেখে মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এত আঘাতের পর কী করে বাঙালি মাথা তুলে দাঁড়ালো; এ অংক যেন মিলাবার নয়। গা ঝাড়া দিয়ে নেকড়ের দল হামলে পড়লো যুদ্ধের ময়দানে। এটুকু যথেষ্ঠ মনে হয়নি শেয়ালের দলের। তাই তারা হানা দিল ঘরের ভেতর। প্রিয়জনের আর্তনাদ পৌঁছেছিল রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের কানে। এই ছিল হায়েনাদের অভিনব দাবার চাল। এবার নিশ্চয় ঘরে ফিরে যাবে বাঙালি বীর যোদ্ধারা।

সে গুঁড়ে বালি। আমাদের সাহসী দামালেরা এবার বাহির-ঘর দুদিক সামলে হায়েনাদের সমস্ত কুটবদ্ধি ভেস্তে দিল। ষড়ঋতুর বৈচিত্রের সাথে পাল্লা দিতে দিতে পাক সেনারা ক্লান্ত। যখন তেজি সূর্যের ছটা গায়ে লাগতে শুরু করলো ঠিক সেসময় প্রতিবেশী বন্ধুদের প্রশিক্ষিত সেনারা যোগ দিল বাংলার দামাল যোদ্ধাদের সাথে। তার দুদিন পর অবশেষে কাঙ্ক্ষিত উজ্জ্বল সূর্যটি বাংলার আকাশকে আলোকিত করে দিল। সেই আলোতে জ্বলজ্বল করছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জ্বল মুখগুলো।

আমরা ফিরে পেলাম আমাদের স্বাধীন স্বদেশের মাটি। এ যেমন গর্বের তেমনি মহা আনন্দেরও বটে। তবে এ মাটির বুকচিরে তখনও হাহাকারের শব্দ। একদিকে নির্যাতিত নারীর আর্তনাদে মাটি ফুঁড়ে কান্নার রোল; আরেকদিকে বাংলার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলকারীদের চির নিস্তব্দ নিথর দেহ। বিজয় এসেছে বাংলার ঘরে ঘরে। তবুও সব ঘরে আতশবাজির ঝলকানি নেই; আছে অপেক্ষার অতন্দ্র দুটো চোখ। এখনও যে ফিরেনি তার আপনজন অপেক্ষার দিন গুণে গুণে ক্লান্ত তবুও হাল ছাড়ে না। তাই আনন্দের আতশবাজিও আর জ্বালানো হলো না।

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

সর্বাধিক পঠিত

20G